• ২০ আগস্ট, ২০২৫

মাইলস্টোন ট্রাজেডি : একসাথে স্কুলে এক সাথে কবরেও

মাইলস্টোন ট্রাজেডি : একসাথে স্কুলে এক সাথে কবরেও

উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে দগ্ধ দুই ভাই-বোন নাফি ও নাজিয়ার করুণ মৃত্যু শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, রাষ্ট্রের গাফিলতি ও মানবিকতার চরম পতনের প্রতিচ্ছবি। এই প্রতিবেদনে উঠে এসেছে তাদের শেষ মুহূর্তের হৃদয়বিদারক কাহিনি এবং পরিবারের নিঃশব্দ শোক।

ঢাকা : ঢাকা শহরের ব্যস্ততম দিনগুলোর একটি দিন ছিল-২১ জুলাই। স্কুল ছুটির সময়। অভিভাবকেরা বাচ্চাদের নিতে এসেছেন। শিক্ষার্থীদের কোলাহলে তখন মুখর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাঙ্গণ। এরই মাঝে হঠাৎ আকাশে বিস্ফোরণ! মুহূর্তেই স্কুল মাঠে আগুনের শিখা, আতঙ্কিত দৌড়াদৌড়ি-আর তারপর এক ভয়াবহ নীরবতা।

এই নীরবতাই যেন প্রতীক হয়ে উঠেছে ভাই-বোন আরিয়ান আশরাফ নাফি ও তাহিয়া আশরাফ নাজিয়ার মৃত্যুর পরে ছড়িয়ে থাকা শোকের। যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে তারা দুজনেই আগুনে ঝলসে গিয়েছিল। একদিন পরপর-২২ ও ২৩ জুলাই পৃথিবী ছেড়ে চলে যায় তারা। নাজিয়ার ৯০ শতাংশ, নাফির ৯৫ শতাংশ শরীর পুড়ে গিয়েছিল। বার্ন ইনস্টিটিউটের বেডে শুয়ে তারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

এ যেন শুধু একটি দুর্ঘটনা নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্বহীনতা, সামাজিক অসচেতনতা এবং মানবিকতার এক গভীর পতন।

নাজিয়া যখন বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন, ভাইয়ের খোঁজ করছিল। পরিবারের লোকেরা সাহস জোগাতে বলেছিলেন, “ভাই ভালো আছে।” হয়তো ভেবেছিল, ক’দিন পর ভাইয়ের সঙ্গে আবার স্কুল যাবে। কিন্তু কে জানত, হাসপাতালের ওই বিছানাই হবে শেষ আশ্রয়? নাফি তখন আর কথা বলছিল না, শুধু মাকে খুঁজছিল। দুজনেই নিজের পরিচয় দিয়ে আত্মীয়দের কাছে পৌঁছাতে চাইছিল। আগুনে বিকৃত চেহারায় কেউ কাউকে চিনতেই পারছিল না!
২১ জুলাই নাজিয়াকে ‘ডিটেনশনে’ রেখেছিলেন শিক্ষক-কারণ আগের দিন হোমওয়ার্ক করতে পারেনি। নাফি স্কুল ছুটি শেষে মায়ের কাছে চলে এসেছিল, কিন্তু বোন কেন দেরি করছে জানতে গিয়ে আবার স্কুলে ঢুকেছিল। ওই সময়ই বিধ্বস্ত হয় যুদ্ধবিমান। বলা যায়, দায়িত্বের বোধেই ভাই-বোন হারিয়ে গেল চিরতরে।

মা তাহমিনা আক্তার এখন অন্তঃসত্ত্বা। সামনে আরেকটি সন্তান আসবে হয়তো, কিন্তু দুই সন্তানের মৃত্যু তাকে স্থবির করে দিয়েছে। বাবা আশরাফুল ইসলাম অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য। এখন যেন শুধু নীরব কান্নাই তাদের ভাষা।
খালা তানজিনা বললেন, “কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই, কিছু চাই না।” কিন্তু তার চোখের ভাষা বলছিল ভিন্ন কথা-এই সমাজ, এই রাষ্ট্র, এই সিস্টেম কি একটুও দায় নেবে না?
এ ঘটনা একটি প্রশ্নের সামনে আমাদের দাঁড় করায়-অগ্নিদগ্ধ শিশুদেরকে বাঁচানোর আগে আমরা কি ক্যামেরা চালাই? ঘটনাস্থলে অনেকে এগিয়ে না গিয়ে ভিডিও করছিল। এই কি আমাদের বিবেকের অবস্থা? প্রযুক্তি যখন মানবিকতাকে পেছনে ফেলে, তখন সমাজের চেহারা এমনই হয়—নির্মম, যান্ত্রিক, আত্মকেন্দ্রিক।
প্রশ্ন ওঠে, এই যুদ্ধবিমান কেন জনবহুল এলাকায় ট্রেনিং ফ্লাইটে ছিল? কোনো জরুরি অবতরণের ব্যবস্থা ছিল না? স্কুলের ওপরে উড়তে দেওয়া কি যুক্তিসঙ্গত ছিল? আর এমন দুর্ঘটনার পর দায় নেবে কে? দায় কার-পাইলটের? প্রশিক্ষকের? নাকি রাষ্ট্রের?
রাজধানীর কামারপাড়ায় রাজাবাড়ি দক্ষিণপাড়া কবরস্থানে পাশাপাশি কবর দেওয়া হয়েছে নাফি ও নাজিয়াকে। মা-বাবা এখন ওই কবরের পাশে বসে থাকেন, কেউ কিছু বলতে পারেন না। এ যেন এক জাতির ব্যর্থতার প্রতীক-দায়িত্বহীনতা, পরিকল্পনাহীনতা ও অনুতাপহীন প্রজন্মের এক নিরব প্রতিবিম্ব। যুদ্ধবিমান ছিল আকাশে, কিন্তু তার আগুনে পুড়ে গেছে মাটির দুটো কচি ফুল।
এই মৃত্যু শুধু দুই ভাইবোনের নয়। এটি একটি রাষ্ট্রের নৈতিক মৃত্যুও। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্ত, নিরাপত্তা পুনর্বিন্যাস ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সময় এখনই।
আমরা যদি আবারও চুপ করে যাই, তবে আগামীকাল আরও এক নাফি-নাজিয়ার মৃত্যুতে কেবল আফসোসই লিখে যাব-প্রতিবাদ নয়।
মানুষের মৃত্যু সংখ্যা নয়, সে একটি গল্প। আর এই গল্প যেন আর কোনো মায়ের জীবনে পুনরাবৃত্তি না হয়-এই হোক শোকের ভাষা।
 

ঢাকা বাংলা রিপোর্ট

How puzzling all these changes are! I'm never sure what I'm going to turn into a tidy little room.