ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে ঘিরে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অপরাধ চক্র। চক্রের সদস্যরা কখনও রোগী, কখনও রোগীর স্বজন সেজে হাসপাতালে ঢুকে। এরা নির্বিঘেœ ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়ায়। সুযোগ বুঝে নানান কৌশলে রোগী এবং স্বজনদের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে যায়। আবার চক্রের কেউ কেউ রোগী ভাগানোর সঙ্গেও জড়িত। মাঝেমধ্যে দুয়েকজন আটক হলেও কৌশলের কারণে অনেকেই রয়ে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিনই ঢামেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে রোগী এবং রোগীর স্বজনদের মোবাইল ফোন ও মানিব্যাগ চুরি হচ্ছে। চোরেরা জরুরি বিভাগ এবং বহিঃবিভাগ থেকে চিকিৎক দেখানোর টিকেট কেটে ভেতরে ঢুকে। এরা ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে ঘুরে চুরি এবং প্রতারণার কাজ করে। হাসপাতালে শুধু মোবাইল চোরচক্রে জড়িত রয়েছে অন্তত ২০ জন সদস্য। তাদেরকে চতুর্থ শ্রেনীর কোন কোন কর্মচারিও সহযোগিতা করে থাকে।
গত সোমবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নতুন ভবনের ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে এক রোগীর স্বজন সাদির মোহাম্মদের একটি মোবাইল ফোন চুরি করে পালানোর সময় তিনি ফয়সাল নামে এক চোরকে হাতেনাতে ধরেন। পরে তাকে গণধোলাই দিয়ে ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পে সোপর্দ করা হয়। পুলিশ জানিয়েছে, এর আগেও ফয়সাল মোবাইল ফোন চুরির অপরাধে আটক হয়েছিল। ফয়সালকে আটকের খবর পেয়ে ছয়-সাত ভুক্তভোগি হাজির হন ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পে। তারা প্রত্যেকেই জানান, তাদের মোবাইল ফোন চুরি হয়েছে এই হাসপাতাল থেকে। ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডের এক রোগীর স্বজন যুগান্তরকে বলেন, রোববার ভোরে ওয়ার্ড থেকে তার একটি মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়। তিনি অভিযোগ করে বলেন, এই হাসপাতালে কর্মচারি এবং নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে চোরদের যোগসাজস রয়েছে। নতুবা চোরেরা কিভাবে হাসপাতালে ঢুকে একের পর এক মোবাইল চুরি করে যাচ্ছে-প্রশ্ন তুলেন তিনি।
#প্রতিদিনই চুরি হচ্ছে মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ
ঢামেকের ২০০ নম্বর ওয়ার্ডের পাশে সিঁড়ির নীচে রেখে চিকিৎসা নেওয়া এক রোগীর স্বজন জানান, সোমবার সকালে তার দুটি মোবাইল ফোন চুরি হয়ে যায়। ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডের আরেক ভুক্তভোগি জানান, তারও একটি স্মার্টফোন চুরি হয়েছে এখান থেকে। তারা মোবাইল চোর ধরার খবর পেয়ে ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। তবে তাদের ফোন উদ্ধার করা যায়নি।
গত রোববার চিকিৎসকের অ্যাপ্রোন পরা অবস্থায় এক নারী প্রতারককে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। গত ৯ জুন মোবাইল চোর চক্রের ৫ সদস্য মিন্টু, মাইনুল, সজিব, স্বপন ও আজিমকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করা হয়। গত ২৬ এপ্রিল একটি আইফোন চুরি করে পালিয়ে যাওয়ার সময় জয়নাল নামে এক চোরকে আটক করা হয়। এরা ছাড়াও বহু অপরাধী ঢামেক কর্তৃপক্ষ আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেছে।
ঢামেকে নিরাপত্তার স্বার্থে আনসার সদস্যদের পাশাপাশি পুলিশ ও বিজিবি ডিউটি পালন করছে। এতো নিরাপত্তার পরও কিভাবে চোর এবং প্রতারক হাসপাতালের অভ্যান্তরে ঢুকছে এ বিষয়ে একজন আনসার সদস্য জানান, অপরাধ চক্র কখনও রোগীর স্বজন সেজে, আবার কখনও রোগী সেজে হাসপাতালে প্রবেশ করে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বহির্বিভাগ থেকে ডাক্তার দেখানোর কথা বলে টিকেট নিয়ে এরা ভিতরে প্রবেশ করে। এরপর এরা বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে রোগী এবং স্বজনদের মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ চুরি করে। কেউ কেউ দুর-দুরান্ত থেকে আসা রোগীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদেরকে এ হাসপাতাল থেকে ভাগিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিকেলে জরুরি বিভাগ থেকে টিকেট নিয়ে চক্রের সদস্যরা হাসপাতালে ঢুকে। হাতেনাতে না ধরতে পারলে এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। কারণ এরা এক ধরণের লিগ্যালিটি নিয়েই হাসপাতালে প্রবেশ করে।
#রোগী ভাগিয়ে নেওয়া হয় প্রাইভেট ক্লিনিকে
ঢামেক সূত্র জানায়, রোগী ভাগানোসহ নানা প্রতারণা বন্ধে বেসরকারি ক্লিনিক ও ওষুধ কোম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভদের হাসপাতালে প্রবেশ নিষেধ করেছে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। এরপরও কোম্পানীর প্রতিনিধিরা নানান কৌশলে হাসপাতালে ঢুকছে।
ঢামেক হাসপাতালের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসারের প্লাটুন কমান্ডার (পিসি) মিজানুর রহমান বলেন, ঢামেক ঘিরে মোবাইল চোর চক্রের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এরা রোগীর স্বজন সেজে ভেতরে ঢুকে। যে কারণে তাদেরকে সব সময় সনাক্ত করা যায় না। তবে প্রায়ই আমরা মোবাইল ফোন চোরকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করি। তিনি বলেন, আমরা চলতি বছরের এ পর্যন্ত শতাধিক অপরাধীকে ধরে পুলিশে সোপর্দ করেছি। অপরাধীরা রোগী এবং রোগীর স্বজন সেজে কৌশলে হাসপাতালে প্রবেশ করায় এদেরকে সহজে ধরা যায় না।
ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, হাসপাতালে কোন অপরাধী আটক হলে তাকে আমরা শাহবাগ থানায় হস্তান্তর করি। অনেক সময় কেউ বাদি হয়ে মামলা দিতে চায় না। যে কারণে নানা ফাঁকফোঁকরে বেরিয়ে আসে অপরাধীরা।